October 27, 2025, 11:48 pm
Headline :

বিদেশ ভ্রমণে বাংলাদেশিদের ভিসা জটিলতা : কোন দেশে কী সমস্যা

বিদেশ ভ্রমণে বাংলাদেশিদের ভিসা জটিলতা : কোন দেশে কী সমস্যা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

বিদেশে উচ্চশিক্ষা, চিকিৎসা, ভ্রমণ কিংবা কাজের উদ্দেশ্যে প্রতিবছর হাজার হাজার বাংলাদেশি পাড়ি জমান। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই স্বপ্নপূরণের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভিসা জটিলতা। নানা দেশের নীতিমালা পরিবর্তন, অবৈধ অভিবাসনের প্রবণতা, ভুয়া কাগজপত্র এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের ওঠানামা মিলিয়ে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা পাওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।

শিক্ষার্থী ভিসা সংকটে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

সুইডেনের লিনিয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া এক শিক্ষার্থীর ঘটনা এর সাম্প্রতিক উদাহরণ। ভিসা জটিলতার কারণে তিনি নির্ধারিত সময়ে পড়াশোনা শুরু করতে পারেননি। টিউশন ফি বাবদ জমা দেওয়া আট লাখ টাকাও ফেরত পাবেন কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন তিনি।

বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও জাপানে হাজারো শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য আবেদন করে। কিন্তু ভিসা সংকটে অনেকের পথ আটকে যাচ্ছে। শিক্ষা ভিসা নিয়ে কাজ করা এজেন্সিগুলোর মতে, আগে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০০ আবেদনের বিপরীতে অন্তত ৩০ জন ভিসা পেতেন। এখন সেই হার নেমে দাঁড়িয়েছে প্রায় শূন্যতে, শতকরা ৯৫ শতাংশ আবেদনই বাতিল হচ্ছে।

ইউরোপের দেশগুলোতেও দেখা দিয়েছে একই চিত্র। যেসব দেশের দূতাবাস বাংলাদেশে নেই, সেখানে আবেদন করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা পড়ছেন নতুন সমস্যায়। ভারতের ভিসা কঠিন হয়ে যাওয়ায় দেশটিতে থাকা ইউরোপীয় দূতাবাসগুলোতে আবেদন করাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। পর্তুগাল, মাল্টা কিংবা স্লোভেনিয়ার মতো দেশগুলো বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন করে নানা শর্ত আরোপ করেছে।

পর্যটন ও চিকিৎসা ভিসায় বাধা

বিদেশ ভ্রমণ কিংবা চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে বেশি আবেদন করা হয় ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও চীনের মতো দেশে। কিন্তু অবৈধভাবে থেকে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় এসব দেশ পর্যটক ও চিকিৎসা ভিসায় কঠোরতা এনেছে।

ভারতের ক্ষেত্রে গত বছরের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর কয়েক মাসের জন্য সব ধরনের ভিসা বন্ধ ছিল। যদিও বর্তমানে চিকিৎসা ভিসা আংশিকভাবে চালু হয়েছে, পর্যটন ভিসা এখনও সীমিত। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোতেও ভিসা পেতে সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছে। একসময় যেখানে অন অ্যারাইভাল ভিসা পাওয়া যেত, এখন সেখানে আগে থেকেই অনুমতি নিতে হচ্ছে।

একটি ট্রাভেল এজেন্সির কর্মকর্তা জানান, আগে দুই সপ্তাহে ভিসা পাওয়া যেত। এখন ফিডব্যাক পেতেই দেড় থেকে দুই মাস লেগে যাচ্ছে। তিনি বলেন, “আমাদের অনেকেই টুরিস্ট ভিসায় গিয়ে আর ফেরেন না। এ কারণেই দেশগুলো আরও সতর্ক হচ্ছে।”

শ্রমবাজারেও ভিসা সংকট

বাংলাদেশের বড় রেমিট্যান্স উৎস মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারেও নেমে এসেছে ভিসা সংকট। বায়রার সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম বলেন, “মালয়েশিয়া, দুবাই, ওমান, বাহরাইন—সব শ্রমবাজার প্রায় বন্ধ। এখন শুধু সৌদি আরবেই সুযোগ আছে।”

ইউরোপের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা। রোমানিয়া, পোল্যান্ড বা চেক প্রজাতন্ত্রে কিছু সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশে দূতাবাস না থাকায় কার্যত শ্রমিকদের জন্য প্রক্রিয়া কঠিন হয়ে উঠেছে। তাছাড়া যেসব শ্রমিক ইউরোপের এক দেশে গিয়ে অন্য দেশে চলে যান, তাদের কারণে পুরো বাজারেই আস্থা সংকট তৈরি হয়েছে।

কেন ভিসা জটিলতা বাড়ছে?

বিশেষজ্ঞদের মতে, এর প্রধান কারণ হলো— বিদেশে গিয়ে অবৈধভাবে থেকে যাওয়ার প্রবণতা, ভুয়া ডকুমেন্ট ব্যবহার করে আবেদন, অভ্যন্তরীণ নীতির পরিবর্তন, বাংলাদেশের প্রতি বাড়তি নজরদারি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ভিসা দেওয়া বা না দেওয়ার সম্পূর্ণ এখতিয়ার সংশ্লিষ্ট দেশের। তবে বাংলাদেশিরা যেন বৈধভাবে ভিসা পান, সেজন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা হচ্ছে।

সমাধানের পথ কোথায়?

পররাষ্ট্র বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একদিকে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বাড়াতে হবে, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণভাবে অবৈধ অভিবাসন রোধে কঠোর হতে হবে। দক্ষ কর্মী তৈরি, দেশের ভেতরে কর্মসংস্থান বাড়ানো এবং বৈধ মাইগ্রেশন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করলেই কেবল সংকট কমবে।

সম্প্রতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশের ভিসা সংকটের পেছনে নিজেদের দায়ও কম নয়। তিনি বলেন, “আমাদের কোনো কাগজ পৃথিবীতে বিশ্বাসযোগ্য নয়। এত নিখুঁত নকল আর কেউ করতে পারে না।”

ভিসা জটিলতায় বর্তমানে শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শ্রমিক—সবার স্বপ্নই আটকে যাচ্ছে সীমান্তের কাগজে-কলমে। তাই এই সমস্যা সমাধান করা না গেলে ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতি থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Our Like Page