নিজস্ব প্রতিবেদক:
একসময় কাজের খোঁজে ভারতে পাড়ি দিয়েছিলেন, ফিরে আসলেন খালি হাতে। কিন্তু সঙ্গে ছিল এক স্বপ্ন—নিজের ছোট্ট উদ্যোগে রঙিন মাছ চাষ। মাত্র ৬২০ টাকা মূলধন দিয়ে শুরু করা সেই স্বপ্ন আজ পরিণত হয়েছে দেড় কোটি টাকার ব্যবসায়, যেখানে কর্মসংস্থান পেয়েছে ৫০ জন। সাইফুল গাজী, যিনি এখন পরিচিত ‘রঙিন মাছের কারিগর’ হিসেবে, তার সংগ্রাম, অধ্যবসায় ও সফলতার গল্প নিয়ে অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন দেশের যুব সমাজকে।
স্বপ্নের সূত্রপাত
সাইফুল গাজী বলেন, “আমাদের সংসারে অভাব ছিল চরম। সাত ভাই-বোনের মধ্যে আমি বড়। ১৯৯৭ সালে অভাবের কারণে ভারতে গিয়েছিলাম। সেখানে টেক্সটাইল মিলে কাজ করতাম। একদিন একটি গ্রামে গিয়ে দেখি পুকুরে নানা রঙের মাছ চাষ হচ্ছে। দৃশ্যটি আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। তখনই মনে হলো, দেশে ফিরে আমি এমন মাছ চাষ করব।”
দুই বছর সাত মাস পর দেশে ফিরে পরিবারকে বললেও কেউ রাজি হননি। সবাই বলেছিলেন, “এতে টাকা ডোবে।” তবুও ইচ্ছা মুছে যায়নি। পরে ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করতে গিয়ে মিরপুরের এক দোকানে রঙিন মাছ দেখে পুনরায় স্বপ্ন জেগে ওঠে। অবশিষ্ট ৬২০ টাকা দিয়ে কিছু মাছ কিনে বাড়িতে নিয়ে শুরু হয় ছোট্ট হাউজে মাছ চাষ।
কষ্ট ও অধ্যবসায়
প্রথম দিকে প্রায় সব মাছ মারা যেত। কিন্তু সাইফুল হাল ছাড়েননি। ধীরে ধীরে মাছের যত্ন, প্রজনন ও পানি ব্যবস্থাপনার কৌশল শিখে পাঁচ বছর পর আসে সাফল্য। এখন তার ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে ২০টি পুকুর ও ৮৮টি হাউজে, যেখানে চাষ হচ্ছে ২৬ প্রজাতির রঙিন মাছ।

মাছ বিক্রি হয় ১০ টাকা থেকে ১২০ টাকায়। ঢাকার কাঁটাবন, খুলনা, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে সরবরাহ করা হয়। আগে বিদেশ থেকে আনতে হতো, এখন নিজেরাই উৎপাদন করছেন। সরকারি সহযোগিতা ও আধুনিক প্রযুক্তি পেলে বিদেশেও রপ্তানি সম্ভব হবে।
বিশেষ উদ্ভাবন
সাইফুল গাজী ‘সিল্কি কই’ নামে ঝলমলে একটি রঙিন মাছ তৈরি করেছেন। মাছটির দেহ দেখতে অনেকটা ঝরির মতো ঝলমলে, এবং এর চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে এখনো বড় পরিসরে উৎপাদন সম্ভব নয়।
কর্মসংস্থান ও সামাজিক অবদান
পাঁচ বছর ধরে মোহাম্মদ খোকন এখানে মাছের পোনা উৎপাদন, খাবার দেওয়া ও বাজারজাতকরণে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ২২ জন এখানে কাজ করি, বেতনের মাধ্যমে পরিবার সুন্দরভাবে চলে। হাসানুজ্জামান জানান, প্রতিদিন ২০–২৫টি পুকুরের দেখাশোনা করি। বৃষ্টি বা রোদ যাই হোক, কাজ বন্ধ থাকে না। মাছ ডেলিভারি দিতে গেলে নিজেই করে থাকি। বেতন থেকে সংসার সুন্দরভাবে চলে।

ঢাকা আহসানিয়া মিশনের কলারোয়া শাখার ব্যবস্থাপক গোলাম সারোয়ার বলেন, “সাইফুলের পরিশ্রম সত্যিই অনুপ্রেরণীয়। তার উদ্যোগে এলাকার মানুষদের কর্মসংস্থান হয়েছে, দেশ ও সমাজে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তরুণরা তার গল্প দেখে অনুপ্রাণিত হোক।”
উপসংহার
সাইফুল গাজী বলেন, “অভাব আমাকে শিখিয়েছে, চেষ্টা করলে কিছুই অসম্ভব নয়। একসময় আমি অন্যের শ্রমিক ছিলাম, আজ ৫০ জনের কর্মসংস্থান করেছি। রঙিন মাছ শুধু আমার জীবন নয়, আশপাশের অনেক পরিবারের জীবনও রঙিন করেছে।
স্বপ্ন, অধ্যবসায় ও পরিশ্রম—এই তিনের মিশ্রণে এক সময়ের হতদরিদ্র সাইফুল গাজী আজ দেশের পরিচিত উদ্যোক্তা। তার গল্প প্রমাণ করে, সুযোগ না পেলে তৈরি করতে হয় সুযোগ। সাহসী উদ্যোক্তাদের এই উদাহরণ দেশের যুব সমাজের জন্য এক অনুপ্রেরণা।