স্টাফ রিপোর্টার,
রাজধানীর ফার্মগেটে মেট্রোরেলের একটি পিলারের বিয়ারিং প্যাড পড়ে আবুল কালাম (৩৫) নামে এক পথচারী নিহত হয়েছেন। রোববার (২৬ অক্টোবর) দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ফার্মগেট মেট্রোরেল স্টেশনের নিচে এ দুর্ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলেই মারা যান আবুল কালাম।
এই দুর্ঘটনার পর ঢাকার অন্যতম প্রধান গণপরিবহন মেট্রোরেলের চলাচল বন্ধ হয়ে যায় প্রায় তিন ঘণ্টা, ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে স্টেশনগুলোতে উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়।
দুর্ঘটনার বিবরণ
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আবুল কালাম ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় তার মাথার ওপর দিয়ে মেট্রোরেল চলাচল করছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে উপর থেকে একটি ভারী ধাতব অংশ ‘বিয়ারিং প্যাড’ (ওজন প্রায় ৮০ কেজি) ছিটকে পড়ে তার মাথায় আঘাত হানে। তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। সঙ্গে থাকা পাসপোর্ট থেকে পুলিশ তার পরিচয় শনাক্ত করে— আবুল কালাম, বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ঈশ্বরকাঠি গ্রামে। দুর্ঘটনার পর পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।
তদন্ত কমিটি ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা
দুর্ঘটনার পর মেট্রোরেল পরিচালনাকারী সংস্থা ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) তাৎক্ষণিকভাবে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে। তিন ঘণ্টা পর উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত আংশিক সেবা চালু হয়, আর মতিঝিল থেকে শাহবাগ পর্যন্ত চলাচল শুরু হয় সন্ধ্যা সোয়া ৭টায়।
এদিকে, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন:
বুয়েটের অধ্যাপক ড. এ বি এম তৌফিক হাসান, এমআইএসটির সহযোগী অধ্যাপক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাহিদুল ইসলাম, ডিএমটিসিএলের প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুল ওহাব, উপসচিব আসফিয়া সুলতানা (সদস্য সচিব)। দুই সপ্তাহের মধ্যে এই কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আগের দুর্ঘটনা ও নিরাপত্তা উদ্বেগ
এর আগে, গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর একই এলাকায় একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল। যদিও তখন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি, তবে ১১ ঘণ্টা মেট্রোরেল বন্ধ ছিল। দ্বিতীয়বার একই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটায় প্রশ্ন উঠছে রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নিয়ে।
ডিএমটিসিএলের এমডি ফারুক আহমেদ বলেন,“আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত রুট আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। বাকি অংশ নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে পুনরায় চালু করা হবে।”
আবুল কালামের জীবনের গল্প
শরীয়তপুরের তরুণ উদ্যোক্তা আবুল কালাম ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। তিনি নারায়ণগঞ্জে স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে বসবাস করতেন এবং একটি ট্রাভেল এজেন্সি পরিচালনা করতেন।
তার মেজো ভাবি আছমা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “দুপুরে শেষবার কথা হয়েছিল। সে বলেছিল—‘ইলিশ কিনে রাখেন, দুই দিন পর বাড়ি আসব।’ কিন্তু সে আর ফিরে এলো না”।
চাচাতো ভাই আব্দুল গণি চোকদার বলেন, “নিজের পরিশ্রমে ঢাকায় ব্যবসা দাঁড় করিয়েছিল কালাম। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা সরকারের অবহেলার ফল। এখন তার পরিবারের দায় কে নেবে?” নিহত আবুল কালামের ছেলে আব্দুল্লাহ (৫) ও মেয়ে সুরাইয়া (৩)— দুই শিশুই এখন বাবাহীন।
সরকারের প্রতিক্রিয়া
দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে সড়ক ও রেল উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান জানান, “নিহতের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। পরিবারের কোনো কর্মক্ষম সদস্য থাকলে তাকে মেট্রোরেলে চাকরি দেওয়া হবে।”
শেষ কথা
একটি ‘বিয়ারিং প্যাড’— যা মেট্রোরেলের ভারসাম্য ধরে রাখার জন্য ব্যবহৃত— পড়ে গেলেই থেমে যায় এক তরুণ উদ্যোক্তার জীবন, ভেঙে যায় এক সুখী পরিবারের স্বপ্ন। রাজধানীর নিরাপত্তা কাঠামো নিয়ে এখনই প্রশ্ন তুলছেন সাধারণ মানুষ: “মেট্রোরেল যখন নিরাপদ আকাশপথে চলে, তখন মাটিতে চলা মানুষ কি নিরাপদ?”।