নিজস্ব প্রতিবেদক,
ঢাকার পুরান শহরের হৃদয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এখন শোকাবহ এক নাম। মাত্র ২৩ দিনের ব্যবধানে এ বিশ্ববিদ্যালয় হারিয়েছে তাদের পাঁচ তরুণ প্রাণ—তিনজন বর্তমান ও দুজন সাবেক শিক্ষার্থী।
মৃত্যুর কারণ আলাদা হলেও প্রতিটি হারানো জীবনের পেছনে আছে একেকটি বেদনাময় গল্প, অগণিত অসমাপ্ত স্বপ্ন।
ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ২০১৬–১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী হাসিবুর রহমান ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক। গত ৩ অক্টোবর রাতে পুরান ঢাকার স্টার কাবাবে দলের অন্য নেতাকর্মীদের সঙ্গে খাবার খাওয়ার সময় হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করেন তিনি। মুহূর্তের মধ্যেই হার্ট অ্যাটাকে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সহপাঠীরা দ্রুত ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলেও চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
তরুণ এই ছাত্রনেতার আকস্মিক মৃত্যুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিক অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। সহপাঠীদের চোখে হাসিবুর ছিলেন পরিশ্রমী, সদালাপী ও নেতৃত্বে অগ্রগামী এক মুখ।
ডেঙ্গুতে প্রাণ গেল ইতিহাস বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী সানজিদার
ইতিহাস বিভাগের ২০১৮–১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সানজিদা ইসলাম ছিলেন সবার প্রিয় মুখ। তিন দিন জ্বরে ভোগার পর হাসপাতালে ভর্তি হন, কিন্তু আর ফিরে আসেননি। ৮ অক্টোবর ঢামেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ডেঙ্গু জ্বরে তার মৃত্যু হয়।
সহপাঠীরা জানান, সানজিদা ছিলেন অত্যন্ত মনোযোগী ছাত্রী। শিক্ষকেরা তাকে বলতেন ‘বিভাগের উজ্জ্বল মুখ’। অল্প সময়েই তিনি সহপাঠীদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন। তার মৃত্যু ডেঙ্গু পরিস্থিতির ভয়াবহতাকেও নতুনভাবে সামনে এনেছে।
টিউশন করতে গিয়ে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার জোবায়েদ
মাত্র ২৫ বছর বয়সে পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭–১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী জোবায়েদ হোসেন হারালেন জীবন। ১৯ অক্টোবর পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় এক বাসায় টিউশন করাতে গিয়ে ছুরিকাঘাতে খুন হন তিনি। ছাত্রী বর্ষা ও তার প্রেমিক মাহির তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে, কারণ জোবায়েদ তাদের সম্পর্ক মেনে নিচ্ছিলেন না। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে অন্ধকার সিঁড়ির নিচে ডেকে নিয়ে যায় তারা, এরপর মাহির ও তার বন্ধু আয়লান মিলে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে।
পুলিশ দ্রুত তদন্ত করে হত্যার সঙ্গে জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীরা বলছেন, “জোবায়েদ ছিল পরিশ্রমী, শান্ত স্বভাবের। পড়াশোনা ও রাজনীতি দুটোতেই সে দক্ষ ছিল।” তিনি জবি ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন।
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল মা-মেয়ের
২৪ অক্টোবর সুনামগঞ্জ–সিলেট সড়কের ইনাতনগর এলাকায় ঘটে ভয়াবহ এক দুর্ঘটনা। হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ২০০৫–০৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মানজুরা আক্তার পরিবারসহ টাঙ্গুয়ার হাওরে বেড়াতে যাচ্ছিলেন বিসিআইসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে।
তাদের বহনকারী সেঁজুতি ট্রাভেলসের বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে যায়। বাসের নিচে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান মানজুরা আক্তার ও তার ১০ বছর বয়সী মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত স্থানীয়রা জানান, “এক মুহূর্তে সব শেষ হয়ে গেল। মা-মেয়ের নিথর দেহ উদ্ধার করার সময় সবাই কেঁদেছিল।” এ দুর্ঘটনা শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সারা দেশের অভিভাবকদেরও নাড়া দিয়েছে।
মেট্রোরেল দুর্ঘটনায় সাবেক শিক্ষার্থীর মৃত্যু
২৬ অক্টোবর দুপুর সোয়া ১২টার দিকে রাজধানীর ফার্মগেটে ঘটে অপ্রত্যাশিত এক দুর্ঘটনা। ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ২০০৮–০৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আবুল কালাম হাঁটছিলেন ফুটপাথে, তখন মেট্রোরেলের একটি পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড (স্প্রিং) ছিটকে পড়ে সরাসরি তার ঘাড়ে লাগে।
মুহূর্তেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তার মুখ ও নাক দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে, এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তিনি মারা যান। এ ঘটনায় পাশের দোকানের মালিকও আহত হন। দুর্ঘটনার পর সামাজিক মাধ্যমে নিরাপত্তা ঘাটতি নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন ওঠে। অবকাঠামোগত অব্যবস্থাপনা যে প্রাণঘাতী হতে পারে—এ দুর্ঘটনা যেন তারই নির্মম উদাহরণ।
শোকের ভারে নুয়ে পড়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
মাত্র ২৩ দিনে পাঁচটি প্রাণ হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা—সবাই যেন এক ধরনের শূন্যতা বয়ে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির এক সদস্য বলেন,
“এ যেন এক অভিশপ্ত মাস। একটার পর একটা মৃত্যু সংবাদ শুনে আমরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি।”
বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষে পরিকল্পিত সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। যেখানে উৎসবের আলো জ্বলবার কথা, সেখানে আজ নিভে গেছে সব আলোকসজ্জা। শিক্ষার্থীরা মোমবাতি জ্বালিয়ে স্মরণ করেছেন তাদের প্রিয় সহপাঠীদের। পুরান ঢাকার আকাশে ঝুলে আছে একটাই প্রশ্ন—এই তরুণ প্রাণগুলো কি এমনভাবে হারিয়ে যেতে থাকবেই?
শেষ কথা
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ধারাবাহিক মৃত্যুর ঘটনায় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে—আমাদের সমাজ ও ব্যবস্থার কতটা নড়বড়ে দিক: অসচেতনতা, অব্যবস্থাপনা, অপরাধপ্রবণতা এবং স্বাস্থ্য সংকট। অল্প সময়ের ব্যবধানে পাঁচটি জীবন নিভে যাওয়া শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষতি নয়, এটি পুরো সমাজের এক গভীর আত্মসমালোচনার সময়।