বিনোদন ডেস্ক
বাংলা সিনেমায় চার দশকের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অসংখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। রোমান্টিক হিরো থেকে শুরু করে গম্ভীর বাস্তবধর্মী চরিত্র—সবখানেই তিনি নিজের মুন্সিয়ানায় দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন। কিন্তু পরিচালক শুভ্রজিৎ মিত্রের নতুন ছবি দেবী চৌধুরানী তাঁকে যেন এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। এই সিনেমায় ভবানী পাঠকের চরিত্রে প্রসেনজিৎ শুধু অভিনয়ই করেননি, বরং চরিত্রের ভেতরে ঢুকে নিজেকেই যেন ছাড়িয়ে গেছেন।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস থেকে নির্মিত এই সিনেমা নিছক সাহিত্য অবলম্বনে তৈরি নয়, বরং ইতিহাসের এক দলিলও বটে। ইংরেজ শাসনবিরোধী বিদ্রোহ, নারীর ক্ষমতায়ন, অসাম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা—সব মিলিয়ে গল্পের পটভূমি সময়োচিত ও প্রাসঙ্গিক। ব্রিটিশ আর্কাইভে ‘ব্যান্ডিট কুইন’ নামে যিনি পরিচিত, সেই দেবী চৌধুরানী এখানে কেবল এক ডাকাত রাণী নন, বরং এক বিপ্লবের প্রতীক। আর তাঁর গুরু, দার্শনিক ও যোদ্ধা ভবানী পাঠককে ঘিরেই প্রসেনজিতের অভিনয়ের বিস্তার।

শান্ত, স্থির এক সাধক যখন দেশরক্ষায় রূপ নেন কঠোর যোদ্ধায়—প্রসেনজিতের অভিনয়ে সেই রূপান্তর এতটাই স্বাভাবিক যে, দর্শককে মুহূর্তে ভেতরে টেনে নেয়। মুখের সূক্ষ্ম অভিব্যক্তি থেকে দৃষ্টি, শরীরী ভাষা—সবখানেই অভিনয়ের এমন পরিশীলন তিনি দেখিয়েছেন যা বাংলা সিনেমায় বিরল। সমালোচক মহলে ইতিমধ্যেই এই চরিত্রকে প্রসেনজিতের ক্যারিয়ারের সেরা কাজগুলোর একটি হিসেবে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে।
শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায় দেবী চৌধুরানীর ভূমিকায় অভিনয় করে দর্শকদের চমকে দিয়েছেন। তাঁর দৃপ্ত অভিনয় সিনেমার আবহকে আরও বাস্তব করেছে। পাশাপাশি অর্জুন চক্রবর্তী ও বিবৃতি চট্টোপাধ্যায় ভবানী পাঠকের দুই সঙ্গীর ভূমিকায় নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। অর্জুনকে একেবারে নতুনভাবে পাওয়া গেল, আর বিবৃতি নিঃসন্দেহে বাংলা চলচ্চিত্রে আরও সুযোগ পাওয়ার দাবিদার।

বাংলার জঙ্গল, পাহাড়, নদী ও গ্রামীণ জীবনের রূপ সিনেমায় দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। যদিও ভিএফএক্স আরও উন্নত হতে পারত, তবে সিনেমাটোগ্রাফি, এডিটিং ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক এই ঘাটতি পূরণ করেছে। বিশেষত বিক্রম ঘোষের সুর করা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছবিটিকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।
প্রথমার্ধ দর্শকদের চমকে রাখলেও দ্বিতীয়ার্ধে কিছুটা দীর্ঘায়িত মনে হতে পারে। কয়েকটি দৃশ্য ছাঁটাই করলে গতি আরও বাড়ত। তবে এর বাইরেও সিনেমার শক্তি দর্শককে শেষ পর্যন্ত বেঁধে রাখে।

যেখানে ইতিহাস, সাহিত্যের ছোঁয়া, শক্তিশালী অভিনয় আর চমৎকার নির্মাণ মিলেমিশে গেছে—দেবী চৌধুরানী নিঃসন্দেহে সেই তালিকায় থাকবে। বিশেষত প্রসেনজিতের অভিনয়ই এই ছবিকে আলাদা জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে। বলা যায়, এই চরিত্রে তিনি নিজেকেই অতিক্রম করেছেন। সংক্ষেপে বলা যায়, দেবী চৌধুরানী শুধুমাত্র একটি সিনেমা নয়, বরং ইতিহাস ও শিল্পের এক অনন্য মেলবন্ধন। আর প্রসেনজিতের অভিনয় এর প্রাণকেন্দ্র।