October 27, 2025, 7:27 pm
Headline :

প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী, হাসপাতালে মশারি থাকলেও ব্যবহার করেন না রোগী!

প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী, হাসপাতালে মশারি থাকলেও ব্যবহার করেন না রোগী!

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে রাজধানী ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের বাসিন্দাদের জন্য আতঙ্ক হয়ে দাঁড়ায় ডেঙ্গু। এডিস মশার কামড়ে ছড়ানো এই রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালগুলোতে রোগীর ভিড় সামলানোই দায় হয়ে পড়ে চিকিৎসকদের। বহু প্রাণহানি ঘটলেও এখনো কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অভাবে প্রতি বছর নতুন করে নাজেহাল হতে হচ্ছে নগরবাসীকে।

হাসপাতালের বাস্তব চিত্র

রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে সরেজমিনে দেখা গেছে, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নতুন করে ভর্তি হয়েছেন সাতজন রোগী; আগে থেকেই ভর্তি ছিলেন ১৩ জন। হাসপাতালটির মেডিসিন ওয়ার্ডেই চলছে সব ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা।

নিয়ম অনুযায়ী রোগীর বেডে মশারি টাঙানো থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে তা দেখা যায়নি। হাসপাতালের এক নার্স নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “মশারি থাকলেও গরমের কারণে অনেকে ব্যবহার করতে চান না। আমরা টাঙিয়ে দিলেও রোগীরা নিজেরাই তা খুলে ফেলেন।”

খিলক্ষেতের বাসিন্দা সজিবুর রহমান চার দিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি বলেন, “ডেঙ্গুর মৌসুমে অন্য হাসপাতালে রোগীদের মশারির মধ্যে থাকতে দেখেছি। কিন্তু এখানে রোগীরা গরমের কারণে মশারি টাঙাচ্ছেন না। আমার মনে হয়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে আরও কঠোর হওয়া উচিত।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ব্যাখ্যা

মশারি না টাঙানোর অভিযোগ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক বিভাগের পরিচালক ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, “রোগীদের বেডে মশারি দেওয়ার সরাসরি নির্দেশনা রয়েছে। কোথাও মশারি না থাকলে ধরে নিতে হবে রোগী নিজেই তা টাঙাতে দেয়নি বা খুলে ফেলেছে। তবুও আমরা খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।”

তিনি আরও জানান, কুর্মিটোলা হাসপাতালে আলাদা ডেঙ্গু ওয়ার্ড না থাকায় মেডিসিন ওয়ার্ডেই রোগীদের চিকিৎসা চলছে। সাধারণত তিন থেকে চার দিন ভর্তি থাকার পর রোগীদের বাড়িতে বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

মৃত্যুর পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক

ডেঙ্গু পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর জানান, চলতি বছর এখন পর্যন্ত ১৭৯ জন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তির ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মারা গেছেন। অনেকেই দেরিতে হাসপাতালে আসায় চিকিৎসকরা যথেষ্ট সময় পাননি।

গত বছরের পরিসংখ্যানও ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। ২০২৪ সালের জুনে মারা যান ৮ জন, জুলাইয়ে ১৪ জন, আগস্টে ৩০ জন এবং সেপ্টেম্বরে সর্বোচ্চ ৮৭ জন। একই সময়ে সেপ্টেম্বরে রোগীর সংখ্যা ছিল সর্বাধিক—১৮ হাজারের কাছাকাছি।

রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপ অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ১৩টি ওয়ার্ডে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চেয়ে অনেক বেশি। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটির ২, ৮, ১২, ১৩, ২২ ও ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড এবং দক্ষিণ সিটির ৩, ৪, ২৩, ৩১, ৪১, ৪৬ ও ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশনের ব্যর্থতা

গত বছর ডিএনসিসি ড্রোন ব্যবহার করে মশার উৎপত্তিস্থল শনাক্ত এবং পরিত্যক্ত জিনিসপত্র কিনে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়। অন্যদিকে ডিএসসিসি খাল ও জলাশয়ে ব্যাঙ, গাপ্পি মাছ ও হাঁস ছেড়ে মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। কিন্তু এসব অভিনব উদ্যোগ কার্যকর না হওয়ায় নগরবাসী উপদ্রব থেকে মুক্তি পায়নি।

বিশেষজ্ঞদের মত

কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, “ডেঙ্গু রোগীর উপস্থিতি ও মশার ঘনত্বের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। রোগী-মশার সংযোগ ভাঙতে পারলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।”

তিনি তিনটি পদক্ষেপ জরুরি বলে উল্লেখ করেন:
১. রোগীকে অবশ্যই মশারির মধ্যে রাখা, যাতে সংক্রমণ চক্র ভাঙা যায়।
২. রোগীর আশপাশে (২০০ মিটার ব্যাসার্ধে) নিয়মিত ফগিং ও স্প্রে চালানো।
৩. পানিজমা পাত্র যেমন টায়ার, টব, প্লাস্টিকের বোতল নিয়মিত পরিষ্কার বা অপসারণ করা।

উপসংহার

ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারি সংস্থা ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ যথেষ্ট কার্যকর হয়নি। চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশাসনিক পদক্ষেপের পাশাপাশি রোগী ও সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মশারি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা এখন সময়ের দাবি।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Our Like Page