October 28, 2025, 7:37 am
Headline :
সালমানকে ভালোবেসে ক্যারিয়ারের ‘বারোটা’ বেজেছে: খল অভিনেতা ডন ৯২ বছরের পল বিয়া অষ্টমবার ক্যামেরুনের প্রেসিডেন্ট নিজে বাসে করে পঞ্চগড় গেছেন নিখোঁজ ইমাম: জিএমপি সৃজিত মুখোপাধ্যায় নির্মাণ করছেন শার্লক হোমসের গল্প অবলম্বনে ইংরেজি ছবি নাঈমুল ইসলাম খান ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা সিদ্ধান্ত নির্বাচনে প্রতিটি কেন্দ্রে থাকছে ১৩ আনসার: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ৬২০ টাকায় শুরু, আজ কোটি টাকার রঙিন মাছের সাম্রাজ্য বাজারের ফল ও সবজি থেকে কীটনাশক দূর করার সহজ ট্রিক প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টের তিন বিচারপতির কাছে জামিন বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইলেন মানবজীবনে দোয়া, জীবনের আলোকবর্তিকা

গুলিতে স্বপ্নভঙ্গ: পাইলট হওয়ার আশা এখন হুইলচেয়ারে বন্দি শিশু মুসা

গুলিতে স্বপ্নভঙ্গ: পাইলট হওয়ার আশা এখন হুইলচেয়ারে বন্দি শিশু মুসা
গুলিতে স্বপ্নভঙ্গ: পাইলট হওয়ার আশা এখন হুইলচেয়ারে বন্দি শিশু মুসা/ ছবি: সংগৃহীত

মো. জোনাব আলী:

বয়স মাত্র সাত। এই বয়সে অন্য শিশুরা যখন রঙিন খাতায় আকাশের ছবি আঁকে, তখন বাসিত খান মুসা আকাশে উড়ার স্বপ্ন দেখত। বলত, “আমি একদিন প্লেন চালাবো।” বাবা-মা সেই স্বপ্নকেই সত্যি করতে চেয়েছিলেন। ইংলিশ ভার্সন স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছিল তাকে। কিন্তু সবকিছু থেমে গেল এক মুহূর্তে—২০২৪ সালের ১৯ জুলাই, রামপুরার রাস্তায় পুলিশের ছোড়া একটি গুলিতে।

সেই এক গুলিতেই বদলে গেছে মুসার পুরো পৃথিবী। মাথায় গুলি লাগার পর থেকে সে আর হাঁটতে পারে না, বলতে পারে না, এমনকি স্বাভাবিকভাবে খাবারও খেতে পারে না। জীবন এখন তার হুইলচেয়ারে সীমাবদ্ধ।

রামপুরার রক্তাক্ত দিন

২০২৪ সালের জুলাই মাস। সারাদেশে তখন ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান। সেই সময় রাজধানীর রামপুরায় সংঘর্ষ চলছিল আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের। সেদিন বিকেলে মুসা ছিল দাদির সঙ্গে। হঠাৎ পুলিশের ছোড়া গুলি গিয়ে লাগে মুসার মাথায়। গুলিটি মাথার এক পাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। একই গুলি বিদ্ধ হয় তার দাদির পেটে। দাদি মায়া ইসলাম ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। আর ছোট্ট মুসা অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে রক্তাক্ত অবস্থায়।

সেদিনের সেই মুহূর্তগুলো এখনো ভুলতে পারেন না মুসার বাবা মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, আমি চিৎকার শুনে দৌড়ে যাই। দেখি, ছেলের মাথা ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে। গুলির ক্ষত চেপে ধরে দৌড়ে হাসপাতালে নিই। পাশে আমার মা পড়ে আছেন নিথর। হাসপাতালেই মারা যান মুসার দাদি। এরপর শুরু হয় মুসার জীবন-মৃত্যুর লড়াই।

‘জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ের পর হুইলচেয়ারের জীবন’

মুসাকে প্রথমে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে নেওয়া হয় সিঙ্গাপুরে। সেখানে একাধিক অস্ত্রোপচারের পর তার মাথার একটি অংশের খুলি সরিয়ে কৃত্রিম স্কাল্প বসানো হয়। ডাক্তাররা জানিয়েছেন, দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন, তবে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কম নয়—যদি নিয়মিত থেরাপি ও উন্নত চিকিৎসা অব্যাহত রাখা যায়।

বাবা মোস্তাফিজ বলেন, ওর মুখে কিছু খেতে পারে না, এনজি টিউব দিয়ে খাওয়াতে হয়। ডান পাশ পুরো প্যারালাইজড। ও নড়াচড়া করতে পারে না, কিন্তু সবকিছু বুঝতে পারে। কেবল বলতে পারে না।

তার চোখ ভিজে ওঠে—“ওর একটাই স্বপ্ন ছিল, পাইলট হবে। এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ থাকে। হয়তো মনে করে, ওড়ার স্বপ্নটা হারিয়ে গেছে।”

আদালতে ছোট্ট সাক্ষী মুসা

সোমবার (২৭ অক্টোবর) সকাল ১১টা। ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ কক্ষজুড়ে ছিল এক অদ্ভুত নীরবতা। হুইলচেয়ারে বসে মুসাকে আনা হয় আদালতকক্ষে। পাশে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম।

ট্রাইব্যুনালে সেদিন ছিল রামপুরার জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের দিন। দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন মুসার বাবা মোস্তাফিজুর রহমান। জবানবন্দির মাঝপথে অবসন্ন হয়ে পড়ে শিশুটি। তখন তাকে সোফায় শোয়ানো হয়, এনজি টিউবের মাধ্যমে তরল খাবার দেওয়া হয়, কিছুক্ষণ পর আবার বসানো হয় হুইলচেয়ারে। আদালতের সবাই তাকিয়ে থাকে শিশুটির দিকে—চোখে অনিশ্চয়তা, মুখে কোনো শব্দ নেই।

বাবার কণ্ঠে আহাজারি

বাবা মোস্তাফিজের কণ্ঠে একের পর এক কান্না মিশে যায়। “আমার একটাই ছেলে। ক্লাসে সবসময় প্রথম হতো। ইংলিশ ভার্সনে পড়ত—শুধু যেন পাইলট হতে পারে। কিন্তু এখন সে নড়াচড়া করতে পারে না। কথা বলতে পারে না। আমি সরকারের কাছে একটাই অনুরোধ—ছেলেটার যেন উন্নত চিকিৎসা হয়, অবহেলায় না পড়ে।”

তিনি আরও বলেন, “গুলিতে আমার মা মারা গেছেন। আমি আদালতের কাছে চাই—যারা এই হত্যার দায়ী, তারা যেন কঠোর শাস্তি পায়।”

প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম বলেন, “এই মামলার দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে হাজির হয়েছেন মোস্তাফিজুর রহমান। তার জবানবন্দিতে উঠে এসেছে কীভাবে পুলিশ ১৯ জুলাই নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল। আদালত আজ সেই গুলিবিদ্ধ শিশুটিকে নিজের চোখে দেখেছে—এটাই প্রমাণ করে আমাদের অভিযোগের সত্যতা।”

তামিম আরও বলেন, মুসার মা নিহত হয়েছেন, আর এই শিশুটি জীবন্ত সাক্ষী—যে এখনো চিকিৎসাধীন। তার শরীরে গুলির দাগই বলছে সেই দিনের নির্মম ইতিহাস।

এই মামলায় অভিযুক্ত রয়েছেন ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পাঁচজন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় রামপুরায় পুলিশের নির্বিচার গুলিতে সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।

পলাতক চার আসামি হলেন— খিলগাঁও জোনের সাবেক এডিসি মো. রাশেদুল ইসলাম, রামপুরা থানার সাবেক ওসি মো. মশিউর রহমান, সাবেক এসআই তারিকুল ইসলাম ভূঁইয়া, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। এ ছাড়া গ্রেপ্তার আছেন চঞ্চল চন্দ্র সরকার, রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক এএসআই। ট্রাইব্যুনাল ইতিমধ্যে পলাতকদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে এবং স্টেট ডিফেন্স আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছে।

সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আদালতকক্ষে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। সাংবাদিক, আইনজীবী, এমনকি বিচারকেরাও তাকিয়ে থাকেন ছোট্ট মুসার দিকে। তার ফ্যাকাসে মুখে কোনো শব্দ নেই—তবু যেন হাজার প্রশ্ন।

একটা শিশুর মাথায় গুলি লাগল, দাদির প্রাণ গেল—এই দায় কার?।

একজন শিশুর স্বপ্ন কেড়ে নেওয়ার বিচার কি কখনো সম্ভব?।

বাবা হুইলচেয়ারের হাতল ধরে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসেন। শিশুটির চোখ তখনও আকাশের দিকে—যেন সেই হারিয়ে যাওয়া নীল আকাশ খুঁজছে, যেখানে তার স্বপ্ন ছিল উড়ে যাওয়ার।

জুলাইয়ের গুলিতে আহত সেই ছোট্ট পাইলট হয়তো আর উড়তে পারবে না, কিন্তু তার গল্প আজ এই দেশের বিবেককে প্রশ্ন করছে— “নিরস্ত্র শিশুর রক্তে যে ইতিহাস লেখা হলো, তার উত্তর কে দেবে?”।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Our Like Page