নিজস্ব প্রতিবেদক :
বিচারক ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে আর সরকারের অনুমতি নিতে হবে না—এমন বিধান রাখা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অধ্যাদেশ ২০২৫-এর খসড়ায়। এর ফলে দুদক সরাসরি মামলা দায়ের করতে পারবে।
গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অধ্যাদেশটির নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এতে ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ৩২(ক) ধারা বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে। ওই ধারায় বলা হয়েছিল, বিচারক বা সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করার আগে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারা অনুযায়ী সরকারের পূর্বানুমতি নিতে হবে।
দীর্ঘদিনের দাবি বাস্তবায়নের পথে
২০০৪ সালে প্রণীত আইনের ৩২(ক) ধারা ২০১৩ সালে হাসিনা সরকারের সময় যুক্ত করা হয়। এ ধারা নিয়ে শুরু থেকেই আপত্তি জানিয়ে আসছিল দুর্নীতিবিরোধী সংগঠনগুলো। ২০১৪ সালে উচ্চ আদালত ধারাটিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে বাতিলের নির্দেশ দেন। এরপর থেকেই এটি কার্যত নিষ্ক্রিয় ছিল।
দুদক সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতেই নতুন অধ্যাদেশের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। কমিশন চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মঈদুল ইসলাম এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “সরকার যদি ৩২(ক) ধারা আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল করে, সেটি প্রশংসনীয় সিদ্ধান্ত হবে। উচ্চ আদালতের রায়ের পর থেকে ধারা কার্যত নিষ্ক্রিয়ই ছিল।” দুদকের কাঠামোগত সংস্কারের প্রস্তাব খসড়া অধ্যাদেশে শুধু মামলার অনুমতি সংক্রান্ত পরিবর্তনই নয়, দুদকের কাঠামোতেও সংস্কারের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। কমিশনারদের মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে চার বছর করা হবে। তিন সদস্যের কমিশনে অন্তত একজন নারী থাকতে হবে। কমিশন গঠনের জন্য সাত সদস্যের একটি নির্বাচনী কমিটি করা হবে, যার নেতৃত্বে থাকবেন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারক।
কমিটির অন্য সদস্যরা হবেন একজন নারী বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি বা বিচার কমিশনের চেয়ারম্যান, স্পিকারের মনোনীত সরকার ও বিরোধী দলের একজন করে সংসদ সদস্য এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত একজন সুশাসন বিশেষজ্ঞ। সংসদ বিলুপ্ত থাকলে সংসদ সদস্যদের বাদ দিয়েও কমিটি গঠন করা যাবে। কমিটি গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আবেদন গ্রহণ করবে এবং প্রার্থীদের জীবনবৃত্তান্ত, সম্পদ বিবরণী ও সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে নির্বাচন করবে। কমিশনার পদের জন্য প্রার্থীদের ন্যূনতম ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে মতবিরোধ দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান খসড়াটিকে “উন্নত সংস্করণ” বলে উল্লেখ করলেও জানান, কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব বাদ পড়েছে। তার ভাষায়, “কমিশনের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে প্রস্তাবিত ‘সিলেকশন অ্যান্ড রিভিউ কমিটি’, শর্টলিস্ট করা প্রার্থীদের নাম প্রকাশ এবং কমিশনারদের কর্মদক্ষতা মূল্যায়নের বিধান বাদ দেওয়া হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “সরকার নিজেই সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, আবার নিজেই তার মূল প্রস্তাবগুলো উপেক্ষা করেছে—এটা সংস্কারবিরোধী দৃষ্টান্ত।” দুদকের এখতিয়ার আরও বিস্তৃত খসড়া অনুযায়ী, যেখানে দুদকের জেলা কার্যালয় থাকবে, সেখানে বিশেষ জজ আদালত স্থাপন করা হবে। এসব কার্যালয় প্রাথমিকভাবে অভিযোগ যাচাই করতে পারবে, এবং যাচাইকৃত অভিযোগ পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন হবে না। এছাড়া দুদকের তদন্ত ক্ষমতা আরও বাড়ানো হয়েছে। এখন থেকে কমিশন দেশের বাইরে থাকা বাংলাদেশি নাগরিক, এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের দুর্নীতি তদন্তের আওতায় আনতে পারবে। ‘জ্ঞাত আয়’ বলতে শুধুমাত্র বৈধ আয় বোঝানো হয়েছে, এবং মামলা, তদন্ত ও অনুসন্ধান প্রক্রিয়া আরও শক্তিশালী করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।