আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক কূটনীতির মঞ্চে নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে ভারত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্যে দিল্লি এখন এক জটিল সমীকরণের মুখে—রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ ঐতিহাসিক সম্পর্ক বজায় রাখবে, নাকি বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সুবিধার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকবে?
ট্রাম্পের দাবিতে কূটনৈতিক ঝড়
হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপের সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রাশিয়া থেকে তেল না কেনার আশ্বাস দিয়েছেন। তবে তিনি একই সঙ্গে হাস্যরস মিশিয়ে বলেন, “আমি মোদীকে ভালোবাসি, কিন্তু দয়া করে আমার এই মন্তব্য নিয়ে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নষ্ট করবেন না।”
এই বক্তব্য প্রকাশ্যে আসতেই ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয় তোলপাড়। বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী অভিযোগ তোলেন—মোদী যুক্তরাষ্ট্রের চাপে নত হয়েছেন। তার ভাষায়, “আমরা ট্রাম্পকে আমাদের হয়ে নীতিগত ঘোষণা দিতে দিচ্ছি—এটা ভারতের সার্বভৌমত্বের জন্য লজ্জাজনক।”
তবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল জানিয়ে দিয়েছেন, “প্রধানমন্ত্রী মোদী ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যে তেল আমদানি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।”
ট্রাম্পের শুল্ক নীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত ভারত
ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপ করা ৫০ শতাংশ বাণিজ্য শুল্ক কার্যকর হওয়ার পর থেকে ভারতের রপ্তানি হ্রাস পাচ্ছে। সেপ্টেম্বর মাসেই যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানি কমেছে ২০ শতাংশ, আর গত চার মাসে পতন প্রায় ৪০ শতাংশ।
দিল্লিভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ–এর পরিচালক অজয় শ্রীবাস্তব মনে করেন, “ট্রাম্পের শুল্কনীতি ভারতের ওপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এবং রপ্তানি আরও কমবে।”
তেলের কূটনীতি: ভারসাম্যের খেলা
ভারত দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়া থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে অপরিশোধিত তেল আমদানি করে আসছে। গত অর্থবছরে দুই দেশের বাণিজ্য রেকর্ড ৬৮.৭ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ভারতের রপ্তানি মাত্র ৪.৯ বিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এখন ভারতের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার—৮৭ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য গেছে যুক্তরাষ্ট্রে।
রাশিয়া থেকে তেল আমদানি কমলেও তা একেবারে বন্ধ হয়নি। ২০২৫ সালের এপ্রিল–আগস্ট সময়ে ভারত রাশিয়া থেকে ১৯.৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের তেল কিনেছে—যা গত বছরের তুলনায় ১১ শতাংশ কম। বিপরীতে একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তেল আমদানি বেড়েছে প্রায় ৭৮ শতাংশ।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারত এখন এক সঙ্কটময় অবস্থায়—“রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করতে চায় না, আবার যুক্তরাষ্ট্রকেও হারানোর ঝুঁকি নিতে পারছে না।”
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: মস্কো-দিল্লির অটুট বন্ধন
স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই রাশিয়া ভারতের ঐতিহ্যবাহী মিত্র। ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নই দিল্লির পাশে দাঁড়িয়েছিল, যখন যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিল।
পরে ৯০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ হলেও, মহাকাশ, পরমাণু ও প্রতিরক্ষা খাতে রাশিয়া আজও ভারতের অন্যতম বড় অংশীদার।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস. জয়শঙ্কর এক বক্তৃতায় বলেন, “রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বিগত পাঁচ দশকে কখনওই অস্থির হয়নি।”
বিশেষজ্ঞদের মত
ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টার–এর দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, “ট্রাম্পের দাবি বিশ্বাসযোগ্য নয়। ভারত হয়তো ইরানের তেল আমদানি বন্ধ করেছিল মার্কিন চাপে, কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক একেবারে ভিন্ন মাত্রার।”
আর সাবেক পররাষ্ট্র সচিব কানওয়াল সিব্বল মন্তব্য করেন, “ট্রাম্প কূটনৈতিক নিয়ম ভেঙে কথা বলেন, নিজের মতো করে তথ্য ব্যাখ্যা করেন—এটাই আসল সমস্যা।”
দ্বিধার ফাঁদে নরেন্দ্র মোদী
বিশ্লেষকরা মনে করেন, মোদীর জন্য পরিস্থিতি এখন “রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দোটানা”—রাশিয়ার তেল কেনা চালিয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হবে। আবার আমদানি বন্ধ করলে রাশিয়ার আস্থা ও জ্বালানি নিরাপত্তা উভয়ই ঝুঁকিতে পড়বে। ব্লুমবার্গ ইকোনমিক্স হিসাব অনুযায়ী, যদি ভারত রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করে, তবে দেশের বার্ষিক আমদানি বিল ৪ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ৬.৫ বিলিয়ন ডলার হতে পারে।
শেষ কথা: ভারসাম্যের রাজনীতি
বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, ভারতের কৌশলগত অবস্থান এখন “দুই পরাশক্তির মাঝখানে ভারসাম্যের খেলা”। ট্রাম্পের মন্তব্য এই ভারসাম্যকে আরও জটিল করে তুলছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মত, ভারত এখনো নিজের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখবে— “ভারত কারও পক্ষ নিচ্ছে না, নিজের স্বার্থেই নিজের পথ বেছে নিচ্ছে।”
এই অবস্থায় প্রশ্ন একটাই—রাশিয়া না যুক্তরাষ্ট্র, শেষ পর্যন্ত কোন দিকে ঝুঁকবে ভারত? উত্তর হয়তো নির্ভর করবে অর্থনীতির চাপে নয়, বরং কূটনৈতিক দূরদর্শিতায়।