October 27, 2025, 7:07 pm
Headline :

জুলাই আন্দোলনে ৩ লাখ ৫ হাজার রাউন্ড গুলি চালায় পুলিশ

নিজস্ব প্রতিবেদক :

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) মো. আলমগীর দ্বিতীয় দিনের সাক্ষ্য দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তিনি বলেছেন, জুলাই আন্দোলন দমাতে পুলিশ সারা দেশে ছাত্র-জনতার ওপর তিন লাখ পাঁচ হাজার ৩১১ রাউন্ড গুলি ছুড়েছিল। এর মধ্যে শুধু রাজধানী ঢাকাতেই ৯৫ হাজার ৩১৩ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করা হয়। সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের দেওয়া ২১৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য তুলে ধরেন তিনি। 

তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দি সম্পন্ন করার জন্য মঙ্গলবার (আজ) দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল। চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি  মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

এদিন তদন্তে জব্দকৃত বিভিন্ন তথ্য ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেন তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর। গত বছরের ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশের চালানো হত্যাযজ্ঞ নিয়ে বানানো একটি প্রামাণ্যচিত্রও ট্রাইব্যুনালে জমা দেন তিনি। এই প্রামাণ্যচিত্র পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, সেদিনের ঘটনায় (৫ আগস্ট) কমপক্ষে ১৯ জন আন্দোলনকারী পুলিশের গুলিতে হতাহত হয়েছেন। এদিন আরও কত আন্দোলনকারী শহীদ হয়েছেন তা নিয়ে কাজ চলছে। 

তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর জানান, শেখ হাসিনার ফোনালাপের ৬৯টি অডিও ক্লিপ এবং তিনটি মোবাইল নম্বরের সিডিআর জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে চারটি ফোনালাপ গত বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ ৫৩তম সাক্ষী কর্তৃক উপস্থাপনের সময় শুনানো হয়েছে। যেটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে। শেখ হাসিনার এই চারটি  ফোনালাপের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও তার আত্মীয় শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে একটি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে দুটি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এএসএম মাকসুদ কামালের একটি ফোনালাপ রয়েছে।

এই মামলায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি আরও দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এর মধ্যে সাবেক আইজিপি মামুন রাজসাক্ষী হিসাবে জবানবন্দি দিয়েছেন। সোমবার তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।

এদিকে যশোরের চৌগাছায় বন্দুক যুদ্ধের নাটক সাজিয়ে ছাত্রশিবিরের দুই নেতাকে গুলির ঘটনায় এসআই আকিকুল ইসলামসহ তিন পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল-১। এছাড়া জুলাই আন্দোলনে উত্তরায় সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের দায়ে দুই আওয়ামী লীগ নেতাকে হাজিরের নির্দেশ দিয়েছেন একই ট্রাইব্যুনাল। এরা হলেন মো. সোহেল রানা ও মো. শাহ আলম। প্রসিকিউশন জানায়, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় গত ২৫ সেপ্টেম্বর এ দুজনকে গ্রেফতার করা হয়।  সোমবার প্রসিকিউশনের পক্ষে ওই দুই আওয়ামী লীগ নেতাকে প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট ইস্যুর জন্য আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে আবেদন মঞ্জুর করে আগামী ২২ অক্টোবর তাদের হাজিরের নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।

এদিকে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের ওপর শুনানির জন্য আগামী ১৪ অক্টোবর দিন ধার্য করা হয়েছে। সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ আদেশ দেন। একই ট্রাইব্যুনালে রংপুরে আবু সাঈদ হত্যা মামলায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী আরমান হোসেনের জবানবন্দি ও জেরা শেষ হয়েছে। মঙ্গলবার (আজ) পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য করেছেন আদালত। 

ইনুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের ওপর শুনানি ১৪ অক্টোবর: সোমবার হাসানুল হক ইনুকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। ইনুর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগের ওপর শুনানির জন্য এক সপ্তাহ সময় চায় প্রসিকিউশন। তবে আসামির পক্ষে আরও দুদিন বাড়িয়ে সময়ের আবেদন করেন নাজনীন নাহার। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আগামী ১৪ অক্টোবর দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল। জুলাই আন্দোলনে কুষ্টিয়ায় ছয়জনকে হত্যাসহ সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় হাসানুল হক ইনুকে একমাত্র আসামি করে গত বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়। এতে তার বিরুদ্ধে মোট আটটি অভিযোগ আনা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ ৩৯ পৃষ্ঠার এই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ)। এতে ২০ জনকে সাক্ষী রাখা হয়। বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ এই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারক মো. মঞ্জুরুল বাছিদ ও বিচারক নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার।

হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরেন প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম। অভিযোগগুলো হলো-হাসানুল হক ইনু তৎকালীন ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল জাসদের প্রধান হিসাবে ঊর্ধ্বতন অবস্থানে থেকে গত বছরের ১৮ জুলাই ‘মিরর নাউ’ নামে ভারতের মুম্বাইভিত্তিক একটি গণমাধ্যমে আন্দোলন দমনে এবং আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য আন্দোলনকারীদের বিএনপি, জামায়াত, সন্ত্রাসী ও সাম্প্রদায়িক ট্যাগ দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের উসকানি প্রদান করেন। গত বছরের ১৯ জুলাই শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ও হাসানুল হক ইনুর উপস্থিতিতে গণভবনে ১৪ দলীয় জোটের সভায় কোটা সংস্কার ও ছাত্র আন্দোলন দমনে দেশব্যাপী সেনা মোতায়েন করে নিরীহ, নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং  সরকার তা কার্যকর করে। এই নির্দেশের সঙ্গে তৎকালীন ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোট সরকারের অংশীদার জাসদের সভাপতি হিসাবে ইনু তার ঊর্ধ্বতন অবস্থান থেকে সরাসরি সম্পৃক্ত হন। তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নির্দেশ বাস্তবায়নে সহায়তা করেন। সেই সঙ্গে প্ররোচনা দিয়েছেন, উসকানি দিয়েছেন ও সহায়তা করেছেন। 

ইনু গত বছরের ২০ জুলাই দুপুরে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনের জন্য তার নিজ জেলা কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপারকে ফোন করেন। আন্দোলনকারীদের ছবি দেখে তালিকা প্রণয়ন ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। ইনু সার্বক্ষণিক শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে আন্দোলন দমনে মারণাস্ত্র (লেথাল উইপন) ব্যবহার করে, ছত্রীসেনা নামানো, হেলিকপ্টার দিয়ে গুলি করে হত্যা, আটক ও নির্যাতনের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা করেন। শেখ হাসিনাকে এসব নির্দেশনা দেন। গত বছরের ২৭ জুলাই ইনু নিউজ টোয়েন্টিফোর চ্যানেলে আন্দোলনকারীদের বিএনপি, জামায়াত সন্ত্রাসী, জঙ্গি, সাম্প্রদায়িক ইত্যাদি ট্যাগ প্রদান করে উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান করেন। সেই সঙ্গে কারফিউ জারি করে মারণাস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারের হত্যাকাণ্ড সংঘটনসহ নির্যাতন-নিপীড়নকে কৌশলে সমর্থন করেন তিনি। 

২৯ জুলাই শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সভায় হাসানুল হক ইনু উপস্থিত থেকে আন্দোলন দমন ও ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করাতে আন্দোলনকারীদের দমনে বিএনপি, জামায়াত সন্ত্রাসী ও সাম্প্রদায়িক ট্যাগ প্রদান করেন। জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব দেন তিনি। এর মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ১৪ দলীয় জোটের সশস্ত্র ক্যাডারের হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনকে বৈধতা দেয়। গত বছরের ৪ আগস্ট আন্দোলন দমনে কারফিউ জারি করে গুলিবর্ষণসহ শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপ অনুমোদন করেন ইনু। শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নে ষড়যন্ত্র, সহায়তায় সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। পাশাপাশি তিনি আন্দোলন দমনে নিজ দলের নেতা-কর্মীদের নির্দেশ প্রদান করেন। 

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা, হাসানুল হক ইনু ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা ও নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী এবং পুলিশ নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর কুষ্টিয়া শহরের বিভিন্ন স্থানে গুলি চালায়। এতে সেদিন আশরাফুল ইসলাম, সুরুজ আলী (বাবু), আবদুল্লাহ আল মুস্তাকিন, মো. উসামা, বাবলু ফরাজী ও ইউসুফ শেখ নামের ছয়জন নিহত হন। গত বছরের ২৬ আগস্ট রাজধানীর উত্তরা থেকে হাসানুল হক ইনুকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বর্তমানে বিভিন্ন মামলায় কারাগারে রয়েছেন তিনি। 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Our Like Page