অনলাইন ডেস্ক:
দেশের সোনার বাজার দিন দিন ছোট হয়ে আসছে। ভ্যাট ও মজুরিসহ ভালো মানের এক ভরি সোনার অলংকার কিনতে এখন ক্রেতাদের গুনতে হচ্ছে দুই লাখ টাকারও বেশি। ফলে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে সোনার গহনা। ক্রেতা সংকটের কারণে অলংকার ব্যবসা কার্যত মন্দায় পড়েছে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বহু দোকানের শোরুম, আবার অনেক ব্যবসায়ী হিমশিম খাচ্ছেন কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে।
বিক্রি কমেছে ৮০ শতাংশ
ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনা মহামারি শুরুর পর থেকেই সোনার ব্যবসায় ধস নামে। বিগত পাঁচ বছরে অর্থনৈতিক অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমার পাশাপাশি সোনার দামে লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি দেখা দিয়েছে। এর ফলে বিক্রি কমেছে আশঙ্কাজনক হারে—প্রায় ৮০ শতাংশ। আগে উৎসব-পার্বণে কিংবা শখের বশে সোনার অলংকার কিনলেও এখন অনেকেই সেটি বাদ দিচ্ছেন। একেবারে বাধ্য না হলে ক্রেতারা জুয়েলারি দোকানে যাচ্ছেন না।
বিশ্ববাজারের রেকর্ড দাম
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বিশ্ববাজারে এক আউন্স সোনার দাম রেকর্ড তিন হাজার ৬৯১ ডলারে ওঠে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। চলতি মাসের শুরুতে প্রথমবার তিন হাজার ৬শ ডলার অতিক্রম করার পর মাত্র এক সপ্তাহে নতুন উচ্চতা ছুঁয়েছে দাম। এর প্রভাব সরাসরি পড়েছে বাংলাদেশের বাজারেও।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) থেকে রেকর্ড দামে সোনার নতুন মূল্য নির্ধারণ করেছে। বর্তমানে ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৬২২ টাকা। ভ্যাট ও মজুরি যোগ করলে এক ভরি অলংকার কিনতে খরচ হচ্ছে ২ লাখ ১০ হাজার টাকার বেশি।
জুয়াড়িদের দখলে সোনার বাজার
বাজুসের সাবেক সভাপতি ওয়াদুদ ভূঁইয়া জানান, সোনার দামের নিয়ন্ত্রণ এখন বিশ্বব্যাপী অল্প কয়েকজন বড় ব্যবসায়ীর হাতে, যাদের অধিকাংশ ইসরায়েলি। বাংলাদেশ বা এশিয়ার কোনো ব্যবসায়ীই এ তালিকায় নেই। তার ভাষায়, “প্রকৃত ব্যবসায়ীরা এখন কোণঠাসা, বাজার দখল করেছে জুয়াড়িরা। সোনার দামকে তারা জুয়ার দানের মতো ব্যবহার করছে।”
তিনি আরও বলেন, সোনার অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির ফলে অলংকার কেনা-বেচা কার্যত শূন্যের কোঠায়। ব্যবসায়ীরা কর্মচারীর বেতন ও দোকানের ভাড়া মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে সামনে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
বাজারের আকার সংকুচিত
২০২৪ সালে বাজুসের এক প্রতিবেদনে দেশের সোনার বাজারের আকার ধরা হয়েছিল দুই লাখ কোটি টাকা। কিন্তু বর্তমানে সেই বাজার প্রায় ২০ শতাংশ সঙ্কুচিত হয়ে দাঁড়িয়েছে দেড় লাখ কোটি টাকার মতো।
বাজুসের ট্যারিফ ও ট্যাক্সেশন স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, “সোনার অলংকার মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। বিক্রি কমে গেছে ৮০ শতাংশের মতো। ফলে ব্যবসার পরিসরও ছোট হচ্ছে। সামনে এই সংকট আরও গভীর হতে পারে।”
দাম বাড়ার কারণ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতির টানাপোড়েন, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলি সংঘাত, ডলারের প্রতি আস্থাহীনতা এবং বড় দেশগুলোর সোনা মজুত করাই বৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতা তৈরি করেছে। একইসঙ্গে খনি থেকে সোনা উত্তোলন কমে যাওয়া সরবরাহ হ্রাস করছে। এসব কারণেই হু হু করে বেড়ে চলেছে সোনার দাম।
সোনার ঐতিহাসিক দাম ২০০০ সালে এক ভরি সোনার দাম ছিল ৬,৯০০ টাকা। ২০১০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪২,১৬৫ টাকা। ২০১৮ সালে প্রথমবার ৫০ হাজার টাকা অতিক্রম করে। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে এক ভরি সোনার দাম এক লাখ টাকা ছাড়ায়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে স্পর্শ করে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বর্তমানে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ টাকারও বেশি।
চোরাচালান ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। বাজুসের হিসাব বলছে, প্রতিদিন প্রায় ২০০ কোটি টাকার সোনা অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কারণে স্থানীয় পোদ্দার বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে প্রতিনিয়ত দাম বাড়ানো হচ্ছে।
সারসংক্ষেপে বলা যায়—বাংলাদেশে সোনার বাজার এখন চরম অস্থির। দাম আকাশচুম্বী, বিক্রি ভাটায়, ব্যবসায়ীরা সংকটে, আর ক্রেতারা পুরোপুরি নিরুৎসাহিত। একসময়ের অপরিহার্য অলংকার এখন বিলাস সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে।