September 10, 2025, 10:48 pm
Headline :
আন্দোলন হাইজ্যাক হয়েছে, দাবি নেপালের তরুণদের নেপালে আটক বাংলাদেশিরা নিরাপদ, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ফিরবেন কুড়িগ্রামে বিজিবির অভিযান: ৭ দিনে ২ কোটি টাকার মাদক ও পণ্য জব্দ ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরণের বাণিজ্য ও আকাশসীমা বন্ধ করেছে তুরস্ক গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার রাজশাহীতে কলাবাগান থেকে যুবকের মরদেহ উদ্ধারনিজস্ব প্রতিবেদক ১৬ গেট দিয়ে সাড়ে ৩ ফুট করে ছাড়া হচ্ছে কাপ্তাই হ্রদের পানি ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের ২১ জেলার যোগাযোগ বন্ধ ডাকসু নির্বাচনে বড় ব্যবধানে জয়ী ‘জুলাই কন্যা’ তন্বী ডাকসুর জয়কে ‌‘জুলাই প্রজন্মের বিজয়’ বললেন নবনির্বাচিত ভিপি

পাকিস্তান কেন বাংলাদেশের সঙ্গে দ্রুত সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী?

পাকিস্তান কেন বাংলাদেশের সঙ্গে ’’দ্রুত সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী?’

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

গত ২৩ আগস্ট পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। এটি ছিল দীর্ঘ ১৩ বছরের মধ্যে কোনো উচ্চপদস্থ পাকিস্তানি কর্মকর্তার প্রথম বাংলাদেশ সফর। ইসহাক দার পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করছেন। তিনি সফরটিকে ‘ঐতিহাসিক’ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং দুই দেশের সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হিসেবে বর্ণনা করেন।

তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উষ্ণতা ফিরেছে এবং গত এক বছরে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। পাকিস্তানি মন্ত্রীর ভাষায়, “আমাদের এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেখানে করাচি থেকে চট্টগ্রাম, কোয়েটা থেকে রাজশাহী, পেশোয়ার থেকে সিলেট এবং লাহোর থেকে ঢাকা পর্যন্ত তরুণ প্রজন্ম হাতে হাত মিলিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে এবং যৌথ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে।”

সাম্প্রতিক কূটনৈতিক ও সামরিক অগ্রগতি

ইসহাক দারের সফর কয়েক মাস ধরে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে চলা কূটনৈতিক ও সামরিক যোগাযোগের বড় অগ্রগতির ফল। গত বছরের আগস্টে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি এবং ছাত্র নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের পর ইসলামাবাদ-ঢাকার সম্পর্ক দ্রুত উন্নতি পেয়েছে। হাসিনা ভারতের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

পাকিস্তানের সাবেক কূটনীতিক মাসউদ খালিদ সতর্ক করে বলেন, অতীতের জটিলতা এখনো দুই দেশের আস্থা তৈরিতে বাধা হয়ে আছে। তবে বাংলাদেশের নতুন সরকার পাকিস্তানের উদ্যোগে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। এখন দরকার গভীরতর সম্পৃক্ততার কাঠামো, যেখানে গঠনমূলক সংলাপ ভুল বোঝাবুঝি দূর করবে।

সামরিক ও কূটনৈতিক সংযোগ

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ গত বছর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দুবার বৈঠক করেন। এই দ্রুত সম্পর্কের উষ্ণতা এবং নিয়মিত উচ্চপর্যায়ের সফর বিশ্লেষকদের জন্য আশ্চর্যজনক।

জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসান পাকিস্তান সফর করেন এবং সেনাপ্রধান জেনারেল অসিম মুনিরের সঙ্গে বৈঠক করেন। ফেব্রুয়ারিতে নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান সফর করেন। এরপর পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালোচ ঢাকায় আসেন। মে মাসে ভারত-পাকিস্তানের চারদিনের সংঘর্ষে ইসহাক দারের সফর বিলম্বিত হয়। অবশেষে আগস্টে তিনি ঢাকায় পৌঁছান। একই সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান পাকিস্তান সফরে যান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দিলওয়ার হোসেন বলেন, পাকিস্তানের এই ‘তড়িঘড়ি প্রচেষ্টা’ কৌশলগত। তারা ১৯৭৫–পরবর্তী সময়কার সম্পর্ক পুনরুজ্জীবনের সুযোগ দেখছে।

মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের কারণে ইসলামাবাদ-ঢাকার সম্পর্ক জটিল। পাকিস্তানি সেনা পূর্ব পাকিস্তানে হত্যাযজ্ঞ চালায়, লাখ লাখ মানুষ হত্যা এবং প্রায় দুই লাখ নারীকে ধর্ষণ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারতের সামরিক সহায়তায় আসে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় পাকিস্তান সম্ভাব্য সুযোগ খুঁজছিল। পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব আজাজ চৌধুরী মনে করেন, ভারতীয় আধিপত্য দুই দেশকে এক করে দিয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ ভারতীয় আধিপত্য টের পেয়েছে এবং মে মাসের সংঘর্ষও এই বিষয়কে সামনে এনেছে।

ঢাবি অধ্যাপক দিলওয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশ সম্পর্ককে শুধু নিরাপত্তা বা সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে পরিচালনা করে।

চীনের প্রভাব

দক্ষিণ এশিয়ার সমীকরণে চীনের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ। বেইজিং পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র। হাসিনার সময়ও বাংলাদেশে চীনের দৃঢ় অবস্থান ছিল। মার্চে ড. ইউনূস বেইজিং সফর করেন, আগস্টে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান চীন সফরে যান। বাংলাদেশ ১২টি জে-১০সি যুদ্ধবিমান কেনার বিষয়ে ভাবছে, যা পাকিস্তানের কাছেও রয়েছে এবং মে মাসের সংঘর্ষে ব্যবহার হয়েছে। চীনের অর্থনৈতিক ঋণ, বিনিয়োগ ও সামরিক সরঞ্জাম দুই দেশের সম্পর্ককে আরও প্রগাঢ় করেছে।

বাণিজ্য ও রাজনৈতিক সংযোগ

ইসহাক দারের ঢাকায় দুদিনের সফরে তিনি ড. ইউনূস, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং ছাত্র নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টির নেতারাও এতে অংশ নেন।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশ ২০২৬ সালের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করলে উভয় দেশ উপকৃত হবে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের রপ্তানি-আমদানি হিসাব অনুযায়ী, পাকিস্তান থেকে রপ্তানি ছিল ৬৬.১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, আমদানি মাত্র ৫.৭ মিলিয়ন। বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে তুলা, বস্ত্রপণ্য, চাল, সিমেন্ট, ফলমূল ও প্রক্রিয়াজাত খাবার আমদানি করতে পারে, আর পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে পাটজাত পণ্য, রাসায়নিক, তামাকজাত পণ্য এবং হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড আমদানি করতে পারে।

ঢাবি অধ্যাপক দিলওয়ার হোসেন বলেন, দুই দেশের সম্মিলিত জনসংখ্যা প্রায় ৪৩ কোটি, যা পশ্চিম ইউরোপের দ্বিগুণেরও বেশি।

ইতিহাসের ক্ষত এবং ভবিষ্যত

১৯৭১ সালের যুদ্ধের উত্তরাধিকার এখনও সবচেয়ে বড় জটিলতা। পাকিস্তান আনুষ্ঠানিক ক্ষমাপ্রার্থনা দেয়নি, প্রায় দুই লাখ উর্দুভাষী বিহারিকে গ্রহণ করতে চায় না, এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সম্পদের ভাগ ও ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সাহায্যের প্রতিশ্রুতি মেনে নি।

তবু পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব আজাজ চৌধুরী মনে করেন, সাধারণ মানুষ পুনর্মিলন চায়। তিনি বলেন, “১৯৭১ সালের ঘটনার বেদনা দুই দেশেরই, এখন মানুষ এগিয়ে যেতে চায়।”

ঢাবি অধ্যাপক দিলওয়ার হোসেন উল্লেখ করেন, হাসিনার পতনের পরও বাংলাদেশের জনগণের মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত মনোভাব মৌলিকভাবে বদলায়নি। তবে কূটনীতি একটি চলমান প্রক্রিয়া। অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খাতে সহযোগিতা বাড়ানোর পাশাপাশি অতীতের ক্ষত সারানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা সম্ভব।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Our Like Page