November 5, 2025, 3:15 pm
Headline :

অতিথি শেখ হাসিনাকে ভারত কি ‘আনলক’ করতে দিচ্ছে?

অতিথি শেখ হাসিনাকে ভারত কি 'আনলক' করতে দিচ্ছে?

জেডটিভি বাংলা ডেস্ক:

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পরও অনলাইনে নিয়মিত বক্তব্য দিচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার এসব বক্তব্যকে কেন্দ্র করে নতুন করে কূটনৈতিক টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে। তবে মিথ্যা ও উসকানিমূলক এসব বক্তব্য দিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ‘অস্থিতিশীল’ করে তুলতে চাইছেন এমন অভিযোগ করে গত ফেব্রুয়ারিতেই বিবৃতি দিয়ে ভারত সরকারকে এর ‘লাগাম কষতে’ বার্তা দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। সেই সঙ্গে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদও জানানো হয়।

অন্তর্বর্তী সরকার অভিযোগ করেছে, শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে। এ জন্য গত ফেব্রুয়ারিতেই ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে সতর্ক করা হয় এবং ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হয়।

তবে পাল্টা বিবৃতিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি করে, দেশটিতে আশ্রয় নিলেও শেখ হাসিনা ‘ব্যক্তি হিসেবে’ এসব বক্তব্য দিচ্ছেন। ভারত সরকারের তার এমন ‘ইন্ডিভিজুয়াল ক্যাপাসিটিতে’ দেয়া বক্তব্যে কোনো ভূমিকা নেই। এমনকি এ নিয়ে ভারতকে ‘নেতিবাচক’ দৃষ্টিতে উপস্থাপন করলে বা ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক ব্যর্থতার’ জন্য তাদের দায়ী করলে, সেটি প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য সহায়ক হবে না বলে মনে করিয়ে দিল্লিতে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাই কমিশনারকেও পাল্টা তলব করা হয়।

পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে দিল্লি ও ঢাকার মধ্যে নজিরবিহীন কূটনৈতিক তিক্ততা তৈরি হয়। এমনকি বিষয়টি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যেও কথাবার্তা হয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই গত ডিসেম্বরে শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে ভারত সরকারকে চিঠি পাঠানোর কথা জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশের বক্তব্য, জুলাই গণহত্যায় অভিযুক্ত শেখ হাসিনাকে ভারত আশ্রয় দিয়েছে ভালো কথা, কিন্তু দু’দেশের মধ্যকার বিদ্যমান প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুসারে তাকে বিচারের মুখোমুখি করতে ঢাকার কাছে হস্তান্তর করা উচিত। এই বিষয়টির নিষ্পত্তির আগেই যদি ভারত তাকে প্রকাশ্যে ‘মুখ খুলতে দেয়’ এবং তিনি তার বক্তব্যের মাধ্যমে দলীয় নেতা-কর্মীদের উসকানি দিয়ে বাংলাদেশে অস্থিরতা তৈরি করতে চান, তাহলে সেটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

তবে ‘কূটনীতিক তিক্ততার’ মধ্যেই অনলাইনে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের উদ্দেশে নিয়মিতই ভাষণ দিতে শুরু করেছেন শেখ হাসিনা। কখনো এটি রেকর্ডেড, আবার কখনো সরাসরি।

শেখ হাসিনার ‘মুখ খোলা’ নিয়ে মুখোমুখি ঢাকা-দিল্লি

গত এপ্রিলে ব্যাংককে বিমস্টেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে শেখ হাসিনার ‘মুখ খোলার’ বিষয়টি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ‘নরেন্দ্র মোদির’ কাছে তুলে ধরেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সে সময় নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য ছিল- বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে কারও মুখের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব নয় এবং শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটছে।

মূলত শেখ হাসিনার মুখ খোলা নিয়ে ভারতের পাল্টা বক্তব্য হলো, গণঅভ্যুত্থানের মুখে ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে ও সুরক্ষার প্রয়োজনে’ দেশটিতে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু ভারত তাকে আশ্রয় দিলেও তিনি কোনো ‘রাজনৈতিক বন্দি’ নন।

রাজনৈতিক বন্দিদের ক্ষেত্রে ভারতে মুঠোফোন ব্যবহার বা অনলাইনে অ্যাক্সেস পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বিধিনিষেধ থাকে। তবে শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে এসব প্রযোজ্য নয়, খবরের কাগজ কিংবা টিভি চ্যানেল অবাধে সার্ফ করার সুযোগ আছে তার। এমনকি শেখ হাসিনার নিজের ব্যক্তিগত মুঠোফোনও প্রথম দিন থেকেই তার কাছে আছে।

পাল্টাপাল্টি এমন সব যুক্তির মধ্যেই গত ২৯ অক্টোবর একযোগে ৩টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে (রয়টার্স, এএফপি ও দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট) শেখ হাসিনার ৩টি পৃথক সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। যদিও সেই সাক্ষাৎকারগুলো লিখিত কিংবা ই-মেইলের মাধ্যমে নেয়া হয়েছে, কিন্তু তারপরও বিষয়টি যে শেখ হাসিনাকে আশ্রয়দাতা ভারত সরকারের সম্মতিতেই হয়েছে, সেটি নিয়ে দিল্লিতে পর্যবেক্ষকদের কোনো সন্দেহ নেই।

প্রায় ৩ মাস আগেও ভারতে সশরীরে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে তার দল আওয়ামী লীগের পলাতক বেশ কয়েকজন নেতার। সেটিও যথারীতি ভারত সরকারের অনুমোদন ছাড়া হয়নি, তা বলার অবকাশ রাখে না। এমনকি সম্প্রতি দিল্লিতে এসে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে গেছেন তার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ও।

এমন সব ঘটনাক্রম বিবেচনায় নিয়ে বিশ্লেষকদের অনেকেই ধারণা করছেন, গণঅভ্যুত্থানে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী দেশটিতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেয়ার পর প্রথম দিকে ভারত তার ওপর যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল, তার অনেকগুলোই ধীরে ধীরে শিথিল করা হচ্ছে। যাকে অনেকেই ‘আনলকিং’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। কিন্তু এই ‘আনলকিং’ এর মধ্যদিয়ে প্রতিবেশী দেশটি কী বার্তা দেয়ার চেষ্টা করছে?

‘আওয়ামী লীগকে প্রাসঙ্গিক রাখার চেষ্টা’

বাংলাদেশ নিয়ে বহু বছর ধরেই গবেষণা করে আসছেন দিল্লিতে শীর্ষস্থানীয় থিংকট্যাংক মনোহর পারিক্কর ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসের (আইডিএসএ) সিনিয়র ফেলো স্ম্রুতি পট্টনায়ক। তার ধারণা, বর্তমান সময়ে শেখ হাসিনাকে যে ভারত ‘মুখ খুলতে’ দিচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তাকে সাক্ষাৎকার পর্যন্ত দিতে দিচ্ছে, এটির মূলে আছে আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রাসঙ্গিক রাখার চেষ্টা। তার ভাষ্য, সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারগুলো যে ভারত সরকারের অগোচরে হয়নি, সেটি স্পষ্টতই বোঝা যায়।

স্ম্রুতি পট্টনায়ক বলেন, বর্তমান সময়ে এখনটা করা হচ্ছে এর কারণ আসলে বাংলাদেশে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চলেছে যেখানে আওয়ামী লীগ কোনো ‘স্পেস’ পাচ্ছে না। ঐকমত্য কমিশন সংস্কার নিয়ে কাজ করেছে, জুলাই সনদ পর্যন্ত সই হয়ে গেছে, অথচ সেখানে আওয়ামী লীগের কোনো ভূমিকাই নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ হলো বাংলাদেশের এমন একটি বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি যাদের সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসিকভাবে সুসম্পর্ক। সেই দলটি যখন সেখানে মুখ খোলারই সুযোগ পাচ্ছে না, তখন ভারতকে তো এটুকু করতেই হবে, শেখ হাসিনাকে বলতে দিতে হবে।

এই গবেষকের ভাষ্য, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা নিয়ে এখনো বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে, তারাও বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মিথষ্ক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগই সেখানে অনুপস্থিত। আমার ধারণা, ভারতও এটি বুঝতে পেরে সেই উপলব্ধি থেকেই শেখ হাসিনাকে এখন আরও বেশি করে বলতে দিচ্ছে। কারণ, এখনও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে শেখ হাসিনাই শেষ কথা।

অনেকটা একই বক্তব্য ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাই কমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাসেরও। তার মতে, শেখ হাসিনার এসব বক্তব্য আসলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করার উদ্দেশেই। সামনেই নির্বাচন আসছে, ফলে হাতে খুব একটা সময়ও আর নেই।

রিভা গাঙ্গুলি দাস বলেন, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা দেশে নেই, সামনের নির্বাচনে তারা লড়ারও সুযোগ পাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ভারতে থাকা শেখ হাসিনার পক্ষে যতটুকু যা করা সম্ভব তিনি সেটিই করছেন। তার হোস্টরাও তাতে আপত্তি জানাচ্ছে না।

তবে ভারতের এমন সিদ্ধান্তে দিল্লি-ঢাকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে তিক্ততা আরও কয়েকগুণ বাড়তে পারে, এমন আশঙ্কাও করছেন অনেক পর্যবেক্ষকরা।

শেখ হাসিনাকে দিয়ে ‘পাল্টা আক্রমণে’ ভারত?

দিল্লিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ বা জেএনইউ-র সাবেক অধ্যাপক ড. বলদাস ঘোষালের মতে, কয়েক মাস আগেই বিবৃতি দিয়ে ভারত শেখ হাসিনার বক্তব্য মানে সেটি দিল্লির বক্তব্য নয়, এমন দাবি করলেও সব ক্ষেত্রে যে কথাটা সত্যি নয়, তা সবার সামনে। বরং, ভারতের পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে বা প্রকাশ্যে যেগুলো বলা সম্ভব নয়, তার অনেক কথাই শেখ হাসিনার মুখ দিয়ে বলানো হচ্ছে।

তার ভাষ্য, ‘আমি তো বলব শেখ হাসিনার এই সাক্ষাৎকারগুলোর মধ্যদিয়ে ভারতই একটু আক্রমণাত্মক অবস্থান নিতে চাইছে। আসলে বাংলাদেশে সম্প্রতি এমন বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে, যেটিকে দিল্লি পরিষ্কার ভারতবিরোধী পদক্ষেপ বলে মনে করছে। যেমন, বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক জেনারেল বা সরকারি কর্মকর্তাদের ঘন ঘন সফর, কিংবা ধরা যাক সেভেন সিস্টার্স নিয়ে উসকানিমূলক বক্তব্য।’

এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, দিল্লিতে অনেকের এমনও ধারণা আছে যে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারত নানা কারণে চাপে আছে বলে বাংলাদেশ বোধহয় সেই কোণঠাসা অবস্থারই সুযোগ নিয়ে কিছু ব্রাউনি পয়েন্ট স্কোর করতে চাইছে! এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে পাল্টা চাপে ফেলার চেষ্টাতেই ভারতে নীতিনির্ধারকদের একটি অংশ শেখ হাসিনাকে সুকৌশলে কাজে লাগাচ্ছেন।

এতে দু’টি উদ্দেশ্য সাধিত হচ্ছে বলে ধারণা করে তিনি বলেন, প্রথমত- শেখ হাসিনার কথাগুলো বাংলাদেশে কী ধরনের প্রভাব ফেলে বা সরকার কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায়, সেটি পরখ করে দেখা যাচ্ছে। আর দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের হতাশ নেতাকর্মীদেরও একটা বার্তা দেয়া যাচ্ছে যে, শেখ হাসিনা দলের হাল ঠিকই ধরে রেখেছেন এবং ভারতও পুরোপুরি তার পাশেই আছে।

তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, শেখ হাসিনাকে “বলা শিথিল” করার এই পদক্ষেপে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক আরও উত্তপ্ত হতে পারে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Our Like Page