জেডটিভি বাংলা ডেস্ক:
এক বছর আগেও দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়ার পর তার বিরুদ্ধে শুরু হয় একের পর এক মামলা। গুম, খুন, দুর্নীতি ও গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত মামলার রায় ঘোষণার অপেক্ষায় এখন দেশ।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সূত্র জানিয়েছে, নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়েই এ মামলার রায় ঘোষণা হতে পারে। ইতিমধ্যে ৫৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য ও জেরা শেষ, চলছে শেষ পর্যায়ের যুক্তিতর্ক ও খণ্ডন পর্ব।
হাসিনা-কামাল-মামুন প্রধান আসামি
এই মামলার আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। প্রসিকিউশনের দাবি, জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পরিচালিত গণহত্যা ও নিপীড়নের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন শেখ হাসিনা।
মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় গত ৩ আগস্ট। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের ঘটনায় আহত খোকন চন্দ্র বর্মণ প্রথম সাক্ষী হিসেবে ট্রাইব্যুনালে বীভৎস চিত্র তুলে ধরেন। এরপর ধারাবাহিকভাবে শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজসাক্ষী, চিকিৎসক, তদন্ত কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞসহ ৫৪ জন সাক্ষ্য দেন।
দালিলিক প্রমাণে উঠে এসেছে ভয়াবহতা
প্রসিকিউশন আদালতে ৯০টি তথ্যচিত্র ও ৩৫টি বস্তুগত প্রমাণ উপস্থাপন করেছে। এর মধ্যে সরকারি নথি, গুলির নির্দেশনা, অডিও-ভিডিও এবং গুরুত্বপূর্ণ ফোনালাপ অন্তর্ভুক্ত।
সাক্ষ্যের সময় আদালতে বাজানো হয় চারটি ফোনালাপ, যেখানে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী নেতাদের মধ্যে কথোপকথনে আন্দোলন দমন ও হত্যার ইঙ্গিত পাওয়া যায় বলে দাবি প্রসিকিউশনের।
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম আদালতে বলেন, “শেখ হাসিনা ছিলেন অপরাধের ‘নিউক্লিয়াস’। তার নির্দেশেই রাষ্ট্রীয় বাহিনী ব্যবহার করে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে।”
‘সর্বোচ্চ সাজা চাওয়া হয়েছে’, টানা পাঁচ দিনের যুক্তিতর্ক শেষে প্রসিকিউশন শেখ হাসিনা ও কামালের সর্বোচ্চ দণ্ড (মৃত্যুদণ্ড) চেয়েছে। তবে রাজসাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেওয়া সাবেক আইজিপি মামুনের বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের ওপর সিদ্ধান্ত ছেড়ে দিয়েছে তারা।
প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম বলেন, “মামুন রাজসাক্ষী হয়ে সত্য উদঘাটন করেছেন। তাই তার সাজা হবে কি না, সেটা ট্রাইব্যুনালই নির্ধারণ করবে।” অন্যদিকে আসামিপক্ষের রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন দাবি করেছেন,
“শেখ হাসিনা ঢালাওভাবে কোনো নির্দেশ দেননি। আইনানুগভাবে রাষ্ট্র রক্ষার জন্য যা দরকার, সেটাই করেছেন।”
‘ক্রাইমস অ্যাগেইনস্ট হিউম্যানিটি’ হিসেবে গণহত্যা প্রমাণিত
ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, প্রসিকিউশন তাদের যুক্তিতে দেখাতে সক্ষম হয়েছে যে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডগুলো ছিল পদ্ধতিগত ও রাষ্ট্রনির্দেশিত অপরাধ, যা আন্তর্জাতিক আইনে ক্রাইমস অ্যাগেইনস্ট হিউম্যানিটি হিসেবে গণ্য হয়।
তদন্তে দেখা গেছে, শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে পুলিশ, বিজিবি, আনসার ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো শান্তিপূর্ণ ছাত্র আন্দোলনের ওপর মারণাস্ত্র ব্যবহার করে। এতে ১৪০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হন এবং হাজারও জন আহত হন।
রায়ের অপেক্ষা এখন পুরো দেশ
সব পক্ষের যুক্তি ও খণ্ডন শেষ হলেই ট্রাইব্যুনাল রায়ের তারিখ ঘোষণা করবে। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এ মামলার রায় বাংলাদেশের বিচার ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক হতে পারে।