October 27, 2025, 10:24 pm
Headline :

এক আগুনে গেলো ১৬ প্রাণ — কবে টনক নড়বে কর্তৃপক্ষের?

এক আগুনে গেলো ১৬ প্রাণ — কবে টনক নড়বে কর্তৃপক্ষের?

জেডটিভি বাংলা ডেস্ক,

মিরপুরের গার্মেন্টস কারখানা ও কেমিক্যাল গোডাউনে মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রাথমিকভাবে ১৬ জন নিহত হয়েছেন; আহত ও নিহতের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ঘন্টা ন’–র পরেও নিয়ন্ত্রণে না আসা আগুন সরায় ফায়ার সার্ভিসকে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাব এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর সহায়তা নিতে হয়েছে—তবু ঘটনাটি নতুন করে একবার আরো প্রশ্ন তুলেছে: ঢাকাকে কি ‘মৃত্যুপুরী’ বানিয়ে প্রেসক্রিপশনটা কখন নাগরিক এবং কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করবে?

শুরুর চিহ্ন থেকে আজকের ট্রাজেডি — পুনরাবৃত্তির ভয়াবহ ইতিহাস

পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় ২০১৯ সালে এবং ২০১০ সালের নিমতলী ট্রাজেডির মর্মান্তিক স্মৃতি এখনও সরfully–। ওই ঘটনায় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারানো সত্ত্বেও, দিন কয়েকের আলোচনার পরে অনেক সুপারিশ ফাইলবন্দি থেকেছে—কয়েক দশক ধরে একই ধরনের সতর্কবার্তা আর ধাপে ধাপে অলক্ষ্য্যই থেকে গেছে। মিরপুরের সাম্প্রতিক ঘটনাও সেই শ 닰 করে দেয়—“একবার গা ঝরলেই” পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

বুয়েটের সাবেক বিস্ফোরণ বিশেষজ্ঞ ও অন্যান্য বিশ্লেষকদের উদ্বেগ হলো—ঢাকা এখন ‘অর্থাৎ এটম বোমার শহর’ লেবেলটাকে ছুঁয়ে যাচ্ছেই; যে কোনো মুহূর্তে বড় ধরনের বিস্ফোরণ বা আগুনে অধিক সংখ্যক প্রাণহানি ঘটতে পারে।

ঘটনাক্রম ও তৎপরতা

মঙ্গলবার সকালে মিরপুরের ওই গার্মেন্টস/কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন লাগে; ঘটনার ন’ ঘণ্টা প্রায় পার হওয়া পর্যন্ত আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে না। ফায়ার সার্ভিসের অভিযানে যোগ দেয় সেনাবাহিনী, বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা। মৃতের সংখ্যা শুরুতে ১৬ জন বলে গণনা করা হলেও হতাহতের সংখ্যা বদলাতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে। মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে এবং আহতদের হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।

কর্তৃপক্ষ ও বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ — কেন রোজই ঘটনা?

আর্কাইভ-মত তথ্য ও বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট—পুরান ঢাকা, মিরপুর, উত্তরা সহ শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্ফোরক বা দাহ্য কেমিক্যালের অসংখ্য গোডাউন এখনও বাসা–বাড়ির নিচে বা ঘনবসতির কাছাকাছি অবৈধভাবে মজুদ রয়েছে। কিছু প্রধান উদ্বেগ:

গোডাউন-হিসেবে অবৈধ অবকাঠামো: পুরান ঢাকায় প্রায় ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন আছে বলে অভিমত; এর মধ্যে বাড়ির নিচে চলমান গুদাম হাজারের ওপর। নিয়মিত উচ্ছেদ ও স্থানান্তরের পরিকল্পনা ধীরগতির: পূর্বের কতগুলো সরকারী উদ্যোগ (যেমন ২০১০ নিমতলী পরবর্তী সুপারিশ, ২০১৯ সালের উচ্ছেদ কর্মসূচি) স্থগিত বা অপ্রয়োগিত থেকে গেছে।

তথ্যভিত্তিক নীতিমালার অভাব: আমদানিকৃত কেমিক্যালগুলোর জন্য পর্যাপ্ত বহন, ব্যবহার ও সংরক্ষণের নীতিমালা নেই—গোয়েন্দা সূত্র অনুযায়ী বিপজ্জনক কেমিক্যাল আমদানি ও ব্যবহারে শিথিল নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।

পুলিশ-ফায়ার সার্ভিস সুপারিশ বৃথা: চুড়িহাট্টা ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস যে সুপারিশ দিয়েছিল—রাস্তাঘাট প্রশস্তকরণ, হাইড্রেন্ট স্থাপন, আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল সরানো—তার অনেকটাই বাস্তবায়ন হয়নি।

বুয়েটের বিস্ফোরণ বিশেষজ্ঞরা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ গবেষকরা একসুরে বলছেন—“ঘটনার পর মানুষ অল্পদিন সতর্ক থাকলেও সবাই আবার পুরনো ছন্দে ফিরে যাচ্ছে। ফলে আমরা বারবার আপনজন হারাই।”

পরিসংখ্যানই সতর্ক বার্তাঃ আগুনের সংখ্যা ও ক্ষতি

ফায়ার সার্ভিসের প্রকাশিত উপাত্ত থেকে প্রেক্ষিত বোঝা যায়—শুধু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা ও ক্ষতির মাপকাঠি বিপজ্জনক: ২০২৩: ২৭,৬২৪টি অগ্নিকাণ্ড/বিস্ফোরণ; ১০২ জন নিহত; প্রায় ৭৯২ কোটি টাকার ক্ষতি। ২০২৪: ২৬,৬৫৯টি ঘটনা; ১৪০ জন নিহত; ৩৪১ জন আহত। ২০২৫ (প্রথম ৭ মাস): ১৫৪ জনের মৃত্যু অগ্নিকাণ্ডে — এই পরিসংখ্যানই বোঝায় সমস্যার ধারাবাহিকতা ও তীব্রতা।

কেন সুপারিশগুলো মাঠে নামল না?

বহু সুপারিশ থাকলেও বাস্তবায়নের ঘাটতি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন কারণ টানেন—অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক জটিলতা, ব্যক্তিগত হিতসংশ্লিষ্টতা ও নীতিনির্ধারকের অনীহা। উদাহরণস্বরূপ: টেকসই স্থানান্তর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি — ২০১৫ সালে কেরানীগঞ্জে কেমিক্যাল পল্লি গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও তা বাস্তবায়ন ধীরগতি বা অন্য কাজে আবंटিত হয়ে যায়। ট্রেড লাইসেন্স-বিহীন গুদাম: পুরান ঢাকায় মাত্র অতিপরিমিতকেই ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে—বাকিগুলো অবৈধভাবে চলছে। কেনাকাটা–বিক্রেতা ও ব্যবসায়ীর চাপ: ব্যবসায়ীদের অনুরোধে বা কার্যত অনুশীলনে উচ্ছেদ অভিযান স্থগিত হওয়ায় সমস্যার স্থায়িত্ব বজায় থাকে। চুড়িহাট্টা, নিমতলী ও মিরপুর—সব অ্যাক্সিডেন্টের পরেই শোরগোল কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের বদলে আলোচনা থেমে যায় বলে অভিযুক্ত নানা পক্ষ।

ব্যবসায়ী এবং পরিবেশগত সংগঠনের কণ্ঠে সতর্কতা

কিছু ব্যবসায়ী স্বীকার করেন—চুড়িহাট্টার পর কিছু ক্ষতিকর কেমিক্যাল সরানো হয়েছে, কিন্তু এখনও অনেক উপাদান ও গুদাম অবশিষ্ট। পরিবেশ সংগঠন এবং প্লাস্টিক ব্যবসায়ীরা দৃশ্যত বলছেন—ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল দ্রুত সরানো না হলে পুনরায় বড় ঘটনা ঘটতেই পারে; তারা নিজাও চান না এমন ঘটনা।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়—কেমিক্যাল আমদানির নীতিমালাও পুরোপুরি সংস্কার হয়নি; ৯ ধরনের কেমিক্যাল আমদানি হওয়া সত্ত্বেও কেবল কিছুটিরই পরিচালনার নীতিমালা রয়েছে—বাকি কেমিক্যাল অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রবেশ করছে।

জরুরি প্রস্তাবনা — এখনই কী করতে হবে?

বিশেষজ্ঞরা এবং সংশ্লিষ্ট অভিক্ষেপ থেকে যা ধরা পড়ে—নির্বাহক ও নীতিনির্ধারকদের কাছে বেশ কিছু তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদী দাবি উঠেছে: অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউন চিহ্নিত করে তাৎক্ষণিক উচ্ছেদ ও স্থানান্তর — বাসাবাড়ি-নিচে যেসব গোডাউন ঝুঁকিপূর্ণ, সেগুলো দ্রুত সরাতে হবে। সামগ্রিক রোডম্যাপ বাস্তবায়ন — ফায়ার সার্ভিসের সুপারিশ (রাস্তাঘাট প্রশস্তকরণ, স্ট্রিট হাইড্রেন্ট, নিরাপত্তা জোন) দ্রুত বাস্তবায়নে সরকারীয় সময়সীমা নির্ধারণ করা। কঠোর রেগুলেশন ও লাইসেন্সিং — কেমিক্যাল আমদানি, সংরক্ষণ ও ব্যবহার বিষয়ে সব ধরনের কেমিক্যালের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তব প্রয়োগ। প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ — ফায়ার সার্ভিস ও এমার্জেন্সি সেক্টরের সক্ষমতা বৃদ্ধি (যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষণ, রেসপন্স টাইম)। জরুরি জনসচেতনতা ও স্থানীয় পর্যায়ের মনিটরিং — ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বাসিন্দাদের তথ্য ও সেভিংকৌশল সরবরাহ।

প্রশ্নটি ফিরে আসে—কবে টনক নড়বে?

ড. মোহাম্মদ তৌহিদুল হক (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) বলেন—“ঢাকার মানুষ বসবাস করছে এক ‘এটম বোমার’ শর্তে। সতর্কতামূলক সিদ্ধান্ত না নিলে নতুন করে আপনজন হারাতে হবে।” বুয়েটের বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ আশিকুর রহমানও জানান—ঘটনার পরই আমরা কিছু সতর্ক হই, কিন্তু দ্রুত তা ভোলে যাই—এখানে সমস্যাটি নীতিনির্ধারকরা সময়মত সিদ্ধান্ত নেয় না।

শ্রদ্ধেয় পাঠক, যখনই আমরা প্রশ্ন করি—কবে টনক নড়বে কর্তৃপক্ষের?—তার মানে স্পষ্ট: আমরা আর কোনো ট্র্যাজেডি মেনে নেব না। প্রতিটি জীবনের মূল্য আছে; আজকের এই ১৬টি জীবন ও গত বছরের শতাধিক প্রাণহানির পরও যদি সার্বিক নীতি-কার্যকর পরিকল্পনা না নেওয়া হয়, তাহলে আমরা প্রত্যাশা করবো রাষ্ট্রীয় প্রতিকার ও গণসচেতনতার আরও জোরালো দাবি।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Our Like Page